১. ৫. ৮. জামা‘আতে সালাতের কতিপয় অবহেলিত সুন্নাত
মাসজিদে প্রবেশের পরে সেখানে পালনীয় অনেক সুন্নাত অজ্ঞানতা বা অবহেলার কারণে আমরা পরিত্যাগ করে থাকি। এ ধরনের মৃত ও পরিত্যক্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত এখানে সংক্ষেপে উল্লেখ করছি। আশা করছি অন্তত কিছু পাঠক এ সুন্নাতগুলো পালন করে মৃত সুন্নাত জীবিত করার অতুলনীয় সাওয়াব অর্জন করবেন এবং লেখকও তাঁদের সাথে সাওয়াবের অংশীদার হবেন।
(১) জামা‘আতে গমনের সময় তাড়াহুড়ো করতে হাদীসে নিষেধ করা হয়েছে। হাদীস শরীফে বলা হয়েছে, সালাতের ইকামত হওয়ার পরেও যদি তোমরা মাসজিদে যাও তাহলেও মানসিক অস্থিরতা বা দৌড়াদৌড়ি করে মাসজিদে যাবে না। শান্তভাবে ও ধীরে ধীরে যাবে। যতটুকু সালাত ইমামের সাথে পাবে তা আদায় করবে, বাকিটা পরে নিজে আদায় করবে। হাদীস শরীফে বলা হয়েছে, ঘর থেকে সালাতের জন্য বের হওয়ার সময় থেকেই মুসল্লী সালাতের মধ্যেই থাকেন এবং আল্লাহর কাছে তিনি সালাতরত বলে গণ্য হন। যদি কেউ মাসজিদে গিয়ে দেখেন যে পুরো জামা‘আত শেষ হয়ে গিয়েছে তাহলেও তিনি জামা‘আতের সাওয়াব পাবেন।
(২) মাসজিদে প্রবেশ করার পর আগের কাতারে জায়গা থাকা সত্ত্বেও পিছনের কাতারে দাঁড়ানো কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ও গুনাহের কাজ। যথাসম্ভব ধীরস্থিরভাবে আগের কাতারে দাঁড়াতে হবে। এতে ইমাম এক রাক‘আত শেষ করে ফেললে কোনো ক্ষতি নেই। আমরা মাসজিদে রাক‘আত গণনা করতে যাই না, সাওয়াব অর্জন করতে যাই। তাড়াহুড়ো করলে, পিছনের কাতারে দাঁড়ালে গুনাহ হবে। আর শান্তভাবে আগের কাতারে দাঁড়ালে সাওয়াব বেশি হবে।
(৩) সালাতের কাতারে যথাসম্ভব গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়াতে, মাঝের ফাঁক বন্ধ করতে ও কাতার সোজা করতে নির্দেশ দিয়েছেন রাসূলুল্লাহ সা.। তিনি ইকামতের পরে মুক্তাদীগণকে কাতার সোজা করার ও কাতারের মাঝের ফাঁক বন্ধ করার নির্দেশ দিতেন এবং তা পালিত হয়েছে কি না পরীক্ষা করতেন। এরপর সালাত শুরু করতেন।
(৪) জামা‘আতে সালাত আদায়ের সময় মুক্তাদী ইমামের অনুসরণ করবেন এবং ইমামের পিছে পিছে সালাত আদায় করবেন। কোন অবস্থাতেই ইমামের আগে সালাতের কোন কর্ম করা যায়েয নয়। কোন কোন মুসল্লী ইমামের আগেই রুকুতে চলে যান, ইমামের আগেই সাজদা করেন বা ইমামের আগেই রুকু সাজদা থেকে উঠে পড়েন। এগুলো কঠিন অন্যায় এবং অনেক সময় সালাত নষ্ট হওয়ার কারণ। রাসূলুল্লাহ সা. এ ধরনের কর্ম থেকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন: “যে ব্যক্তি ইমামের আগেই রুকু বা সাজদা থেকে মাথা উঠায় তার কি ভয় হয়না যে আল্লাহ তার মাথাকে গাধার মাথার মত বানিয়ে দেবেন, অথবা তার আকৃতি গাধার মত করে দেবেন?!”(১৭৩. সহীহ বুখারী ১/২৪৫, সহীহ মুসলিম ১/৩২০।)
বারা ইবনে আযিব বলেছেন: “আমরা রাসূলুল্লাহ সা.-এর পিছে সালাত আদায় করতাম। তিনি যখন “সামিয়াল্লাহু লিমান হামিদাহ” বলে রুকু থেকে উঠতেন তখন আমরাও উঠে দাঁড়াতাম এবং রাসূলুল্লাহ সা.-এর কপাল মাটি স্পর্শ করার আগে আমাদের কেউ তার পিঠ বাঁকাত না। এরপর আমরা সবাই সাজদা করতাম।” (১৭৪. সহীহ বুখারী ১/২৮০, সহীহ মুসলিম ১/৩৪৫।)
(৫) জামা‘আতে সালাত আদায় করলে মুক্তাদীকে ইমামের পিছে পিছে সালাতের তাকবীরগুলি বলতে হবে। অর্থাৎ তাহরীমা, রুকু, সাজদা ইত্যাদির জন্য মুক্তাদীও “আল্লাহু আকবার” বলবেন। তবে রুকু থেকে উঠার সময় ইমাম যখন (সামিয়াল্লাহু লিমান হামিদাহ) বলবেন তখন মুক্তাদী বলবেন “রাব্বানা লাকাল হামদু...”।
(৬) মুক্তাদী যদি কোন রাক‘আতের রুকুতে ইমামের সাথে শরীক হতে পারেন তাহলে তিনি সেই রাক‘আত জামা‘আতে আদায় করতে পেরেছেন বলে গণ্য করা হবে। মাসজিদে প্রবেশ করে যদি দেখেন যে, ইমাম রুকু রত অবস্থায় আছেন, তাহলে তাড়াহুড়ো করে রাসূলুল্লাহ সা.-এর নির্দেশ লঙ্ঘনের গোনাহে লিপ্ত হবেন না। আমাদের উদ্দেশ্য আল্লাহর নিকট সাওয়াব লাভ, রাক‘আতের সংখ্যা গণনা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। যথাসম্ভব শান্তভাবে আগের কাতারে জায়গা দেখে সেখানে দাঁড়ান। দাঁড়ানো অবস্থায় পূর্ণভাবে তাকবীরে তাহরীমা (আল্লাহু আকবার) বলুন। এরপর দ্বিতীয়বার আল্লাহু আকবার বলতে বলতে রুকু করুন। এভাবে রুকু করে যদি ইমামের উঠে পড়ার বা (সামিয়াল্লাহু লিমান হামিদাহ) বলার পূর্বে একবারও তাসবীহ বলতে পারেন তাহলে সেই রাক‘আত আপনি জামা‘আতে পেয়েছেন বলে গণ্য করবেন।
(৭) অনেকে ইমাম রুকু থেকে উঠে পড়লে বা সাজদা করলে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন। ইমাম পরবতীর্ রাক‘আত শুরু করলে জামা‘আতে শরীক হন। এতে তিনি অগণিত সাওয়াব থেকে বঞ্চিত হন। ইমামকে যে অবস্থায় পাওয়া যাবে সেই অবস্থায় তাঁর পিছনে ইকতিদা করতে হবে বা সালাত শুরু করতে হবে। আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় ইবাদত তাঁর জন্য সাজদা করা। কাজেই ইমামকে সাজদায় রত পেলে সাথে সাথে দাঁড়ানো অবস্থায় তাকবীরে তাহরীমা বলে দ্বিতীয় তাকবীর বলে সাজদায় ইমামের সাথে শরীক হতে হবে। উদ্দেশ্য সাওয়াব অর্জন। রাক‘আত গণনা উদ্দেশ্য নয়।
(৮) যে ব্যক্তি ইমামের সাথে পুরো সালাত আদায় করতে পারেন না, প্রথমে দুই/এক রাক‘আত বাদ পড়ে তাকে “মাসবূক” বলা হয়। ইমামের উভয় দিকে দুইটি সালাম আদায়ের পরে তিনি উঠে দাঁড়াবেন এবং যে কয় রাক‘আত প্রথমে বাদ পড়েছে তা একাকী আদায় করবেন। তাকে দুই রাক‘আত পূর্ণ হলে ও শেষ রাক‘আতে পুনরায় বসে উপরের নিয়মে সালাত শেষ করতে হবে। যেমন মনে করুন এক ব্যক্তি ইমামের সাথে আসরের এক রাক‘আত সালাত আদায় করেছেন। তিনি ইমামের উভয় সালামের পরে উঠে দাঁড়িয়ে সূরা ফাতিহা ও অন্য সূরা পাঠ করে উপরের নিয়মে এক রাক‘আত সালাত আদায় করে বসে “আত-তাহিয়্যাতু” পাঠ করবেন। এরপর উঠে দাঁড়িয়ে সূরা ফাতিহা ও অন্য সূরা পাঠ করে রুকু ও সাজাদা করে সরাসরি পরবতীর্ রাক‘আতে উঠে দাঁড়াবেন। শুধুমাত্র সূরা ফাতিহা দ্বারা এই রাক‘আত আদায় করে রুকু সাজদার পরে বসে “আত-তাহিয়্যাতু”, দরুদ ও দু‘আ পড়ে সালামের মাধ্যমে সালাত শেষ করবেন।
(৯) জামা‘আতে সালাত আদায়ের সময় মুক্তাদীগণের জন্য সুতরার প্রয়োজন নেই, ইমামের সুতরা যথেষ্ঠ। তবে সুন্নাত-নফল সালাত আদায়ের সময় সুতরার বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে, যেন মুসল্লীদের চলাচলে অসুবিধা না হয় এবং সামনে দিয়ে কেউ না যায়।
(১০) মাসজিদে প্রবেশ করে বসার আগে ‘দুখূলুল মসজিদ’ বা ‘তাহিয়্যাতুল মসজিদ’ সালাত আদায় করা গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। রাসূলুল্লাহ মাসজিদে প্রবেশ করে বসার আগে অন্তত দু-রাক‘আত সালাত আদায় করতে বারবার উৎসাহ দিয়েছেন। মাসজিদে প্রবেশ করে মাকরূহ ওয়াক্ত না হলে দু—রাক‘আত ‘তাহিয়্যাতুল মাসজিদ’ আদায় করতে হবে। সুন্নাতে মুআক্কাদা বা জামা‘আতে দাঁড়িয়ে গেলেও তাহিয়্যাতুল মাসজিদের সুন্নাত আদায় হবে। কোনো সালাত না পড়ে বসলে এ সুন্নাত পালনের সাওয়াব থেকে আমরা বঞ্চিত হব।
(১১) সালাতে দাঁড়ানোর সময় সামনে, তিন হাতের মধ্যে সুতরা বা আড়াল রাখা রাসূলুল্লাহ সা.-এর নির্দেশিত ও আচরিত সুন্নাত।
(১২) অনেক মুসল্লী সালাতের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দাঁড়ানো, বসা, হাত উঠানো, হাত রাখা ইত্যাদি খুঁটিনাটি সুন্নাত না জানার ফলে অগণিত সাওয়াব থেকে বঞ্চিত হন। এগুলো অভিজ্ঞ আলিমগণের নিকট থেকে ব্যবহারিকভাবে শিক্ষা করা অতি প্রয়োজন।
(১৩) জামা‘আত শেষে সুন্নাত সালাত মাসজিদে আদায় করলে ফরযের স্থান থেকে সরে যাওয়া সুন্নাত। ইমাম আবু হানীফার মতে ইমামের জন্য যে স্থানে ফরয পড়েছেন সে স্থানে অবস্থান বা সুন্নাত আদায় মাকরুহ। তিনি বলেন:... যোহর, মাগরিব ও ইশার সালাতে ইমামের জন্য সালামের পর স্বস্থানে বসে থাকা মাকরূহ। তার উঠে যাওয়া আমার পছন্দ। ফজর ও আসরে ইচ্ছানুসারে উঠে যাবে অথবা... ঘুরে বা মুসল্লীদের দিকে মুখ করে... বসে থাকবে। যোহর, মাগরিব ও ইশার পরে ‘তাতাওউ’ (ঐচ্ছিক বা সুন্নাত) আদায় করতে চাইলে সে মুসল্লীদের পিছনে বা যেখানে ফরয পড়েছে সেখানে ছাড়া মাসজিদের অন্য কোথাও তা পড়বে। মুক্তাদীগণ যদি স্বস্থানে সুন্নাত আদায় করে তবে অসুবিধা নেই। তবে দু-এক পা সরে যাওয়া তাদের জন্য উত্তম।(১৭৫. মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান, আল-মাবসূত ১/১৭-১৮।)
বই: সালাত, দু‘আ ও যিকির, লেখক: প্রফেসর ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহ.

0 Comments